ভিন্ন গদ্য
গল্পের ঘাটে রূপকথার বিশ্রাম
সুরের দোলনের ওপর বসে যে পাখি বার বার ঘাড় ঘুড়িয়ে দেখছে ও আমার খুব চেনা। দক্ষিণ ফ্রান্সে মধুবনে ফুলের উৎসবে এক পেট আসব পান করে ওর গানে কোমর দুলিয়ে ছিলাম। একটু দূরে বসন্ত সাজে শরীরী হিল্লোলে বাতাসকে ভাসিয়ে নিয়ে যাচ্ছে এক কৃষ্ণকলি। পরন্ত সূর্য পিছলে যাচ্ছে ওর কুহক গ্রীবায়। চুরো করে বাঁধা চুলে মেঘের আলস্য। আদিম অপাঙ্গে বেঁচে থাকার নিশি ডাক। বাদামি ঠোঁটে কালিন্দীর ঢেউ। তর তর করে জল কেটে উজানি স্রোতে ভাসছে এক ছোট পানসি। মাথার ওপর পাংশুটে আকাশ। এইমাত্র হাতের রঙিন গেলাসে চলকে উঠল দধিচী মুনির ঋণ, রূপালী আলোয় এক ঝলক দেখলাম নাওয়ের মাঝির মুখ। নবীন যুবক আয়ত দুটচোখে উদাসীন নৈঃশব্দ্য। ঈশ্বরের পরিচয় জানতে চাওয়ায় অপরাধে প্রতিবেশীরা মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে। যতবার গল্প শুনিয়েছেন পরিবর্তনের ততবারই আঁচরে কামড়ে ক্ষত বিক্ষত করেছে সময়। তাই এই অভিসার জলের কাছে, ঝড়ের কাছে, নরম মৃত্যুর আঁচলে, অপার্থিব রাত্রি ভাষ্যের কাছে। মুখের আদল অনেকটা তৃতীয় পান্ডবের মতো, যতবার গাণ্ডীব তুলেছেন হাতে, লক্ষ্য কিন্তু কোনো প্রতিপক্ষ ছিল না। নিজেকে আঘাত করেছেন, ভিতরে ভিতরে ভেঙে এক প্রেয়সীর থেকে অন্য প্রেমের ঘাটে খুঁজেছেন জীবনের মধুক্ষরা পদাবলী। শেষে ব্রজের রাখাল এর কাছে মিটেছে সেই খোঁজ। শান্ত মন মেলে দেখলেন পাখির নীড়ের মতো চোখ তুলে মুখোমুখি বসে কোন সে বনলতা সেন। কুরুক্ষেত্র আর নাটোর একাকার ধানসিড়ির ঘোলা জলে। দু’হাতে মেখে নিয়ে মেঘের ওড়না থেকে ঝরে পড়া গুঁড়ো গুঁড়ো আবীর জলের বিছানায় শুইয়ে দিল সে নিজেকে। পাতার ওপর স্থির হলো স্বপ্ন না পাওয়া অক্ষর যত। তাকে ভাসিয়ে নিয়ে গেলো নিষেধের দেশে, যেখানে যাবার জন্য অমল আর অমলকান্তি কবে থেকে অপেক্ষা করে আছে, পাঁচমুড়ো পাহাড়ের নীচে রোদ্দুরের বেড়া দিয়ে ঘেরা অপার্থিব গ্রামে।
একটা সরু পাকদন্ডী বয়ে উঠে গেলেই পাথর খাদানের বুকে চাপ চাপ কুয়াশার গায়ে গা লাগিয়ে দাঁড়িয়ে আছে পোয়াতি অন্ধকার। শিরশির করে বাতাস দুলছে শালের ডালে। মাহাতো বাড়ির বড় বউয়ের কপালের লাল টিপের মতো আকাশে জ্বল জ্বল করছে নক্ষত্রশ্রেষ্ঠ অরুন্ধতী। দিগন্তের খানিক নিচেই লকলকিয়ে উঠেছে আগুন, ধোয়ার রথে কে সগ্গে গেলো কে জানে। ওই আগুনের দিকে পিঠ করে দাঁড়িয়ে এক আগুনপাখি। ডুড়ে শাড়ির খুঁটে বাঁধা রয়েছে খান কতক নাম ঠিকানাহীন বাসি চিঠি। তেল জবজবে চুলে আজ সে খেজুর ঝাঁটি বিনুনী বেঁধেছে। মাথায় গুজেছে লাল করমচা ফুল। বাজুবন্ধে আর গলায় গুঞ্জা ফুলের সাজ, দৃষ্টিতে শাল ফুলের গন্ধ।
সারাদিন পাথর ভাঙা দু হাতে নরম উষ্ণতা। চাঁদের পরে চাঁদ গিয়েছে, ঢেউ এর পরে ঢেউ। পারের পলি বীজ বুনেছে, মিঠে রঙের পাতার ওপর বড় বউ জোৎস্না বেড়ে দিয়েছে। সারা সংসার ম-ম করেছে খিদের গন্ধে। তারপর নিয়ম মতো এসেছে গল্পের রাত। আদরের বিছানা ভিজেছে শরীরের ধারাপাতে। দংশিত ঠোঁট, বিজন নখাঘাত আর ললাটের উথাল পাতাল শৃঙ্গার খবর দিল গত রাতের বৃষ্টিতে মাটিতে জোয়ার এসেছে কান পাতলে শোনা যাচ্ছে গর্ভের কাঁপন। এতো গেলো যে মাটির কাছাকাছি থাকে তার কুশল বার্তা। যে মাথা উঁচু করে আকাশ পানে খুঁজে বেড়ায় রঙধনুর দেশ, তার কি এতে আশ মেটে! আগুন পাখির নীড়ের দেখাও তাই মিলল না। এখনো সে প্রতি সন্ধ্যায় ওই খাদনের আসে পাশে খুঁজে বেড়ায় তার দস্যু প্রেমিককে, বাতাসে ওড়ায় পরিযায়ী ডাক।
সেই ডাক রুখা পাথরের ধাক্কা খেতে খেতে পেরিয়ে যায় বালির চোরা স্রোত। নীল জলে মন ডুবিয়ে বসে আছে এক দস্যি মেয়ে। লক্ষণ গন্ডির বাধা সে পেরিয়ে এসেছে হেলায়। রাজাকে বশ করেছে শরীরের গানে। সাত সুরের ভেলায় ভাসতে ভাসতে এসে উপস্থিত নেতা ধোবানির ঘাটে। এখান থেকেই নাকি শুরু অমরাবতীর পথ। ইন্দ্র সভায় আজ তার জলসা। বনে বনে সন্ধ্যে ঘনিয়েছে। জোনাক আলোয় তুলসী তলায় রূপকথার আয়োজন। আচ্ছা এই যে দুই বিদুষী লোকগাথার দেখা হলো আধো আঁধারে, কি ভাষায় লিখল ওরা বাঁচিয়ে রাখার গান? ওই যে গলুইয়ে চোখ রেখে হাল ধরে মাঝ দরিয়ায় ভেসে আছে যে মাঝি গলায় ধরে জিরানী সুর, তার দমকে দমকে উথলে উঠেছে পালের আহ্লাদ, তা শুনতে কোনো বর্ণ পরিচয় লাগে না, রসিক। রসকেলির মানে বুঝতে কি শাস্ত্র লাগে নাকি গোঁসাই? ও মন মজলেই বোঝা যায়। চোখের ওপর চশমা এঁটে তুলোট কাগজের পুঁথিতে নাক ডুবিয়ে রাখলে কি পারিজাতের গন্ধ পাওয়া যায়! যে ফুল মালার সুতো পেলো না, সেই জানে রাঙা চরণের ধ্বনি। সুতোয় বাঁধলে সারা জীবন গলায় ঝুলতে হবে ধনী। তার চেয়ে সুতোর মায়া ছেড়ে ধুলোর ওপর আসন পাতো। মাটির হাঁড়ি মাটির সরায় যেমন জোটে মাধুকরী, তাই ফুটিয়ে নাও মনের আঁচে। দেখবে সেই সোহাগী বেলায় জুটে যাবে নানা রঙের স্বজন সুজন। ফিরতি পথের বাঁকে কদমের ডালে রাঙা চরন দুখানি ঝুলিয়ে বসে থাকবে কোনো প্রেমিক ঈশ্বর হাতে নিয়ে রথের মেলায় সদ্য কেনা বাঁশি খানি, উছলে পড়বে রাধা নামের ধুন নিশুতি চরাচরে, চাঁদের গায়ে চাঁদ লাগবে যেমন শঙ্খ লাগে কলঙ্ক বেলায় ফুলশরে।
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন
Thanks for your valuable comment.