রম্যগল্প
কমলির দিব্যদর্শন
সায়ন্তনী পূততুন্ড
ইদানিং লোকে বলছে আমার মাথায় নাকি কিঞ্চিত গোলযোগ হয়েছে! আমি অবিশ্যি কিছুতেই মানবো না। অ্যাঁ, বললেই হল? গোলযোগ কি কিনতে পাওয়া যায় যে কিনে নিয়ে মাথায় ভরে দিলেই হল? লোকে তো বলে আমি নাকি ভয়ঙ্কর নাকও ডাকি! কী ভয়ানক চক্রান্ত! ভগবানের দেওয়া একটা মাত্তর সবেধন নীলমণি বোঁচা নাক! আস্ত ডবল ডেকার নাকের ওপর দিয়ে চলে গেলেও এমন খানদানি বোঁচা নাক পাওয়া যায় না! এ কি উন্নাসিক ইংরেজদের মনুমেন্টের মত নাক পেয়েছো? এমন স্নিগ্ধ ও ছোট্ট নাক দেশের সম্পদ, দশের সম্পদ! এটাকে প্রিজার্ভ করে যাদুঘরে রাখা উচিৎ! সেটাকেও ডাকার বদনাম দিতে হবে? হুঁ হুঁ বাবা! নাক ডাকি বললেই হল? বলি, আমি নিজে তো কখনও শুনিনি যে আমার নাক ডাকছে! হ্যাঁ, হ্যাঁ—অন্যে নাকি শুনেছে! কিন্তু পরের মুখের ঝাল খাব কেন? আগে আমি স্বকর্ণে শুনি, তাপ্পর বিশ্বাস করব।
যাক্গে, ওসব ছেঁদো কথা থাক। যা বলছিলুম। লোকে বলে, আমার মাথায় নাকি কিঞ্চিত গোলমাল হয়েছে। আমি নাকি হ্যালুসিনাচ্ছি! কত বড় বদনাম! কী অন্যায়!
ঘটনাটা বলেই ফেলি তবে! হয়েছে কী, এই সেদিন সক্কালবেলায় ছান—টান সেরে আমি তো আর কিছুতেই চশমা খুঁজে পাচ্ছি না! না, এটা খুব বড় কোনও সমস্যা নয়। প্রায় প্রতিদিনই আমি চশমা খুঁজে পাই নে। দশ মিনিট ধরে হন্যে হয়ে গরুখোঁজা খুঁজতে থাকি। কিন্তু কিছুতেই পাই না! বাবা-মা মুচকি মুচকি হাসেন। যখন চশমা খুঁজে না পেয়ে ‘রেগে আগুন, তেলে বেগুন’ অবস্থা, তখন মা মুচকি হেসে বলেন—‘এভাবে দেখলে হবে না। খালি চোখে খুঁজে দ্যাখ্। পেয়ে যাবি!’
আমি আরও রেগে গিয়ে বলি—‘বললেই হল? চশমা চোখে দিয়েই চশমাটা খুঁজে পাচ্ছি না, খালি চোখে পেয়ে যাবো? অত সহজ?’
বলাই বাহুল্য যে চশমা খুঁজে পেতে আর বেশি সময় লাগে না! তিনি আমার শ্রী মুন্ডে, শ্রী কর্ণ ও নাসিকার ওপর ভর করেই চক্ষুসম্মুখে লটকাইতেছিলেন! আমিই আকাট গর্দভের মতন তাহাকে খুঁজিয়া পাই নাই।
যাই হোক্। সেদিনও যথারীতি চশমা হারিয়ে বেশ বিরক্ত হয়ে দাঁত কিড়মিড়াচ্ছি, আচমকা ডোরবেল বেজে উঠলো! বাবার দরজা খোলার সময় নেই। তার পায়রার পেট খারাপ হয়েছে বলে তিনি মেট্রোজিল ও অ্যান্টিবায়োটিক নিয়ে ব্যস্ত। মা বেগুনের ফালিকে তেলে ফেলে চমকাচ্ছেন! অগত্যা আমিই দরজা খুলতে গেলুম!
দরজা খুলেই পিলে চমকে গেল! দেখি কী...।
কী সব্বোনাশ! একটা ডোরাকাটা হলুদ রঙের হাঁড়িমুখো চারপেয়ে জীব দরজায় দাঁড়িয়ে! থাবা জোড় করে, করাতের মত দাঁতের দাঁতখিঁচুনিটাকে যথাসম্ভব মোলায়েম করে হাসির মত করে বলল—‘হাম্! ইয়ে...মানে, নমস্কার!’
আর হাম্! তখন পালাতে পারলে বাঁচি! আমি খুব খাদ্যরসিক। আর যে দোরে দাঁড়িয়ে আছে, সে আবার খাদ্যরসিকদের খেতে ভালোবাসে। হাম্ শুনে দ্রাম্ করে দরজাটা বন্ধ করব কি না ভাবছি, তার আগেই ব্যাটা বলল—‘ভয় পাবেন না। আমি আপনাকে খেতে চাই না! শুধু আপনার হাতটা চাই!’
সেরেছে! এ তো পুল্লো ‘ইয়ে হাথ হামকো দে দে ঠাকুর’ গোছের ব্যাপার! মানে পুরোটা খাবে না, শুধু হাতটা...!
হাঁড়ির মতন মাথাটা নেড়ে বলল সে—‘না, না—আপনার হাত কামড়াব না! ইয়ে মানে, আঙুলের ছাপ্পাটা চাই আর কী। ভোট আসছে তো! তাই ক্যাম্পেনিং কচ্ছি!’
বলে কী! এই রয়্যাল বেঙ্গল টাইগারটা ভোটে দাঁড়িয়েছে! এতক্ষণে বুকে একটু বল পেলুম। ভোটার অবাধ্য হলেও অবধ্য! আশা করা যায় গাঁক করে খেতে আসবে না। তাই এবার পোজ মেরে দাঁড়ালুম—‘আপনি ভোটে দাঁড়াচ্ছেন? নাম কী?’
হাঁড়িমুখো বিনয়ে একেবারে বৈষ্ণব হয়ে ন্যাজ নাড়িয়ে বলল—‘ আজ্ঞে, হালুম্বচরণ বাগ! আপনাদের আশীব্বাদে টিকিট পেয়েছি আর কী! এখন যদি কৃপা করেন...!’
এবার আম্মো এট্টু ঘ্যাম নিলুম—‘তা ভাই, ভোটে তো দাঁড়িয়েছেন। কিন্তু আপনাদের তো আবার মালা পরার বা পরানোর অভ্যেস নেই। নেতারা তো দুটোই করেন। মালা পরেন ও পরান! কিন্তু টিকিট পাওয়ার দৌলতে আপনাকে মালা যে পরাতে যাবে, তার তো ওপরের টিকিট কাটা হয়ে গেল!’
সে এইয়া বড় জিভ কাটলে—‘আরে, রাম রাম! ওসব তো পুরোনো কথা! ঐ বে-আক্কেলে শিবা কবে কী করেছিল, তাই দিয়ে কী গোটা ব্যাঘ্রসমাজকে বিচার করা চলে! আমরা এখন সিভিলাইজড বাঘ! আমরা সবাই এখন অ্যাঙ্গার ম্যানেজমেন্টের কোর্স করছি!’
বেশ কৌতুহল হল। জিজ্ঞাসা কল্লুম—‘সেটা কেমন একটু শুনি?’
‘এই যেমন কেউ গাল দিলে তাকে কামড়ানো চলবে না! বড়জোর গাল ফুলিয়ে বলতে হবে—‘চো-ও-ও-প! তাপ্পর যদি কেউ বেগড়বাঁই করে তবে তাকে সঙ্গে সঙ্গে পুলিশে দিতে হবে। আর বলতে হবে—‘সব চক্কান্ত! ও ম্যাঁও!’ বলতে বলতে বেচারির মুখ করুণ হয়ে গেছে—‘এই ম্যাঁও বলাটাই এট্টু কষ্টকর! ‘হালুম’ ছাড়া এতদিন আর কিছু মালুম ছিল না কি না!’
‘বেশ। আগে?’
‘কেউ যদি খোঁচা মারে তবে তাকে জিভ বের করে ভেঙচি কাটতে হবে। বলতে হবে—‘এক থাপ্পড় দেবো’।
‘সর্বনাশ! সত্যি সত্যিই থাপ্পড় দেবেন নাকি!’ গলা শুকিয়ে গেল। মানুষের থাপ্পড় তবু সহ্য হয়! কিন্তু বাঘের থাপ্পড় বড়ই বিপজ্জনক!
‘না...না!’ বাঘটা ফের হাসি হাসি মুখভঙ্গি করেছে—‘ওটা তো স্রেফ হুমকি! সত্যিই কী থাপ্পড় মারবো? শুধু থাপ্পড়ই যদি মারতে হয় তবে এত কষ্ট করে বোমা, পেটোগুলো বানিয়েছি কেন?’
অ্যাঁ! বোম বানিয়েছে! কী ভয়ঙ্কর! আমি ঢোঁক গিলে বলি—‘ইয়ে মানে, আপনি বক্তৃতা দিতে পারেন? নেতা হতে গেলে তো বক্তৃতা দিতে হয়’।
‘জানি বৈকি!’ বলে বাঘটা গম্ভীর মুখ করে ভাষণ দিতে শুরু করল—‘মানুষেরা শয়তান, বদমাশ ও বিচ্ছু/ আমাদের তরে ওরা করেনি তো কিচ্ছু...!’
‘একি! মানুষের কাছেই ভোট চাইছেন, আবার মানুষেরই বদনাম করছেন!’ আমি এবার রেগে লাল—‘এটা কী জাতীয় ভদ্রতা!’
‘ওহো!’ বাঘটা এইয়া বড় জিভ কাটল—‘এটা ভোটের পরের ভাষণ। এট্টু ভুল হয়ে গেছে’। সে একটু বিব্রত—‘ভোটের আগের বক্তিমেটা এখনও মুখস্থ হয়নি!’
‘পড়াশোনা কতদূর করেছেন?’
বাঘটা আফ্রিকার নাম না জানা মেডিক্যাল কলেজের সার্টিফিকেট বের করেছে—‘আমি অস্থি-বিশারদ! হাড়ের ওপর পি এইচ ডি করেছি!’
‘হাড়ের ওপর?’ বেশ কৌতুহল হল—‘সেটা কীরকম? বলুন তো, মানুষের শরীরে ক'টা হাড় আছে?’
বাঘটা কিছুক্ষণ মনোযোগ দিয়ে থাবা চাটলো। মনে হল হাড়ের কথা শুনে ব্যাটার মুখে জল এসেছে। ‘উল্স্’ করে জলটা টেনে নিয়ে বলল—‘ক’টা হাড় আছে তা জানি না! তবে কেমন খেতে তা বলতে পারি! যেমন মানুষের হাড় বেশ নরম! ভেতরে রস থাকে। চিবোতে বড় ভালো লাগে...’ ।
বলতে বলতেই জুলুজুলে চোখে আমার দিকেই তাকাচ্ছে দেখে রীতিমত ভয় পেয়েই বলি—‘থাক্, থাক্...আপনি যে মস্ত হাড় বিশারদ তা বুঝেছি। তা ভোট পাওয়ার জন্য কিছু মিথ্যে প্রতিশ্রুতি দিতে হয়, সেটা জানেন?’
বাঘটা এবার হুম হুম হাম হাম করে হাসল—‘পুরো বঙ্গবাসীকে যে মুন্ডু সমেত চিবিয়ে খাবো না, এর থেকে বড় মিথ্যে প্রতিশ্রুতি আর কী হতে পারে?’
সর্বনাশ! বলে কী! আমার চোখ ছানাবড়া! বাঘটা তখন সবিনয়ে বলে চলেছে—‘আমার বেশি কিছু চাইনে। জয়ললিতা মাসির মত শাড়ি বা জুতো তো দূর,শুধু দুবেলা দশ কেজি মাংস পেলেই হবে। আর নিতান্তই যদি একশো দুশো লোক বে-বাক হাওয়া হয়ে যায়, আর ভুল ক্রমে আমি আর আমার ভাই-বোনেরা ঢেঁকুর তুলে ফেলি, তবে নিজগুণে মাজ্জনা করবেন। কত অসামান্য শিক্ষিত শিল্পী মানুষ কোটি কোটি হাম করেও ঢেঁকুর তোলে না! আমি তো সামান্য বাঘ, তাই ঢেঁকুরটাকে বাগে আনতে পাচ্ছি নে!’
কী বলব ভেবে পাই না! এখন হাসি হাসি মুখে তো ভোট চাইছে! পরে ব্যাটা কী চাইবে ঠিক নেই! বাঘটা তখনও বলে চলেছে—‘তাছাড়া ইদানীং গানও শিখেছি। একটু চড়া সুরের! বাঘেশ্রী রাগ! শুনবেন নাকি?’
কোনমতে বলি—‘রক্ষে করুন! গান শোনাতে হবে না! আর কিছু জানেন যেটা তুলনামূলক নিরীহ? মানে ছবি টবি আঁকতে জানেন? ’
‘নিশ্চয়ই’। সে থাবা তুলে দেখায়—‘এই থাবায় লাল নীল রঙ মাখাবো, আর কাগজে যেখানে যেমন খুশি ছাপ্পা মারবো’।
‘যাব্বাবা! সেটা আবার কেমনতরো ছবি! কেউ কিনবে না!'
বাঘটা এবার রেগে গেল—‘কে বলেছে কিনবে না? লোকে কাকের ছবি কিনছে, পেত্নীর ছবি কিনছে আর আমার ছবি কিনবে না? রয়াল বেঙ্গল টাইগারের পাগ মার্কের দাম জানেন? সাহেবগুলো পুল্লো পাগল হয়ে যাবে। কোটি কোটি ডলার দিয়ে কিনবে। ফটাফট্ পাগ মার্ক দেবো, স্যাটাস্যাট বিক্রি করবো!’
আমি তখন পুরো ল্যাম্পপোস্ট! কী চালু বাঘ রে বাবা! এর মধ্যেই আবার বলতে লেগেছে—‘আপনি শিওর যে গান শুনবেন না? ভোটারদের ইমপেস্ করার জন্য শিখেছি কিন্তু...। বাঘেশ্রী রাগ আর হালুম্ব রাগিনী...!’
প্রায় লাফিয়ে উঠি—‘প্লিজ্...প্লিজ্! দয়া করুন। আমি এখনও অনেকদিন বাঁচতে চাই’।
‘আচ্ছা, আজ থাক তাহলে! ’ বাঘটা মোলায়েম দাঁত খিঁচোয়, ইয়ে, সম্ভবতঃ হাসে—‘যখন ক্যাসেট করব, তখন নয় শুনে নেবেন। এখন আসি। ভোটটা আমাকেই দেবেন কিন্তু! আমার রঙ লাল!’ বলতে বলতেই ফিক করে হেসে বলল—‘রক্ত খুব ভালোবাসি কি না!’
আমি তখনও পুরো বাংলা ভাষার লুপ্তাক্ষর ‘৯’ এর মত লুপলুপে হয়ে ল্যাদ খাচ্ছি! হলো'টা কী! শেষমেষ একটা বাঘ ভোটে দাঁড়াচ্ছে! কী সর্বনাশ! তাড়াতাড়ি দরজা জানলা সব বন্ধ করে কাঁপতে কাঁপতে চলে এলুম! সবাইকে যখন ঘটনার কথা বললুম তখন বাবা খ্যাঁক খ্যাঁক করে হেসে বললেন—‘তোর মাথাটা গেছে! হবে না! দিনরাত খালি যত সব ভয়ঙ্কর ভয়ঙ্কর প্লট ভেবে চলেছিস। যা, এখন ঘুমের বড়ি খেয়ে ঘুমো গে!’
মা বললেন—‘মূলো আর ফুলকপি খেয়ে তোর পেট গরম হয়েছে’।
দাদা বলল—‘পেট না, মাথা গরম হয়েছে। চল, তোকে সাইকায়াট্রিস্ট দেখিয়ে আনি!’
ইল্লি আর কী! আমি রীতিমত প্রতিবাদ করি—‘ মোট্টেও আমার মাথা খারাপ হয়নি। যা দেখলাম, তাই বললাম! সত্যিই ইয়াব্বড়া হামদো একটা বাঘ ভোটে দাঁড়িয়েছে!’
সবাই মিলে এমন হাবভাব কল্লে, যেন আমি জুলু ভাষায় কথা বলছি! দাদা গম্ভীর মুখ করে বললে—‘হ্যালুসিনেশন! ডাক্তার দেখানো দরকার। ভালো বুঝছি না।’
আমি মনে মনে ভয়ানক রেগে গেলুম। হুঃ, ‘হেসে নাও, দুদিন বৈ তো নয়’! যখন ঐ বাঘটা ভোটে জিতবে তখন বুঝবে ঠ্যালা! আমায় পাগল বলা! এত্ত রাগ হল যে এক ডজন বেগুনভাজা আর তিন সানকি ভাত এক্সট্রা মেরে দিলুম। বাঘটাকে আমি স্বচক্ষে দেখেছি, অথচ এরা কিনা বিশ্বাসই করছে না! যত্তোসব!
এরপর দুদিন দিব্যি কেটে গেল! কোনও উপদ্রব হয়নি। তবে বাবা বাজার থেকে ফুলকপি আনা বন্ধ করেছেন! দাদাও শুনেছি তলেতলে সাইকায়াট্রিস্টের খোঁজ করছে। করুক গে! গোটাটাই চক্কান্ত! আমি ভালোই জানি, আমার মাথা ঠিকই আছে! পষ্ট দিবালোকে, বিনা চশমায় অমন একটা আস্ত বাঘ চোখের সামনে দেখনু, সব ভুল হতে পারে নাকি! আমায় এখনও ‘বাহাত্তুরে’ তে ধরেনি, কিংবা ‘মুন্নাভাই’ ও নই যে কেমিক্যাল লোচা হবে!
যাই হোক্, এরপর একদিন দিব্যি খেয়েদেয়ে বারান্দায় শুয়ে রোদ পোয়াচ্ছি, বেশ একটা বেড়াল-ঘুম আস্তে আস্তে তন্দ্রা ছড়াচ্ছে, আচমকা কানের কাছে কে যেন বলল—‘কিস্স্স্! কিস্স্স্!'
‘কে রে ব্যাটা!’ চোখ বুঁজেই বলি—‘ খামোখা কিস্স্ কিস্স্ কচ্ছিস কেন বে? কিস চাইলে বর্ধমানে যা! ওখানে কিস মাস্টার জেনারেল বসে আছে...!’
এবার পষ্ট শুনলাম—‘ কিসি কিস্স্স্! কিস্স্ মি বে-বি কিস্স্ মি বে-বি!’
এই দিনদুপুরে ফাজলামি হচ্ছে! চটেমটে চোখ খুললুম। কে রে বদমাশ, এই ভরদুপুরে এসে জ্বালাচ্ছিস?
ওরে বাবা, তাকিয়ে দেখি একখানা কালো কুচকুচে ব্ল্যাক মাম্বা আমার নাকের সামনে এসে পেন্ডুলামের মত ফণা দোলাচ্ছে! আমাকে চোখ খুলতে দেখেই বলল—‘হিসসস্...নমস্স্কার!’
সত্যি বলছি, আমি এই শীতের দুপুরেও ঘেমেঘুমে একসা! কোনমতে বললুম—‘আপনি...আপনি ক্কে!’
ব্ল্যাক মাম্বাটা ফণাটা যথাসম্ভব ঝুঁকিয়ে বলল—‘আজ্ঞে আমি নিসিকান্ত নাগ! আপনাদের সিচরণের দাস্স্স্স্!’
ভয়ে তখন গলা দিয়ে আওয়াজ বেরোচ্ছে না! নিসিকান্ত নাগ! এক ছোবলেই ছবি! সাপটা বোধহয় আমার মনের অবস্থা বুঝেই বলল—‘ভয় পাবেন না! আমি নিতান্তই ভোটপার্থী!
কোনমতে মুখের ঘাম মুছলুম—‘আপনি কোন্ দলের?’
ব্ল্যাক মাম্বা আরও বিনীত—‘আজ্ঞে,ঘুম পাড়ানি মাস্স্সি-পিস্স্সিরা আমাকে দাঁড় করিয়েছে!’
‘আপনি আবার দাঁড়াতেও পারেন!’ আমি এবার বিস্ময়ে হতবাক্--‘কিন্তু আপনারা তো বুকে হাঁটেন জানতাম!’
‘মাস্স্সি পিস্স্সি চাইলে সব করাতে পারেন! সে হিস্ হিস্ করে হাসে—‘মাস্সি-পিস্সি চাইলে আপনি নেহাৎ কাট্টুন আঁকলেও ম্যাঁও হয়ে চাক্কি পিসসসসিং, পিস্স্স্সিং অ্যান্ড পিস্স্স্সিং! আবার পাখিটাখি এঁকেও ক্রোড় ক্রোড় কামিয়ে ফাঁস্স্স্সিং...ফাঁস্স্স্সিং...! আর ফাঁসলেও সেসে মিস্স্স্সিং...মিস্স্স্সিং...!’
এবার নিজেকে সামলে নিয়ে বলি—‘সে তো বুঝলুম! কিন্তু ইংরেজি বলতে জানেন? ভোটে দাঁড়ালে ইংরেজি বলতে হবেই’।
সে সবিনয়ে জানায় –‘জানি বৈকি! তবে আমি অত ভালো জানি না! আমার সঙ্গী চমৎকার ইঞ্জিরি বলে! অ্যাই, কোথায় গেলি? ভোট চাইতে এসে নজ্জা করলে হয়? আয় দিকিন এদিকে!’
কী সাংঘাতিক! আচমকা দেখি পেছন থেকে একটা কিম্ভূতকিমাকার জীব উঁকি মারল। এ কে! ডাইনোসর নাকি! জুরাসিক পার্ক থেকে পালিয়ে এসেছে? আমি প্রাণপণ দৌড় লাগাবো ভাবছি, তার আগেই নিসিকান্ত বলল—‘আরে, ভয় পাচ্চেন নাকি? ও তো আমাদের বুনিপ!’
আমি ঢোঁক গিলে বলি—‘বুনিপ! মানে উনিও ভোটে দাঁড়াবেন?’
‘না!’ সে ফণা নাড়ছে—‘ও তো মাথামোটা! ভোটে দাঁড়াবে কী? ও আমায় হেল্প করবে! গুন্ডাগর্দি করবে। ভয় দেকাতে হলে দেকাবে। দক্কার পল্লে বোম-টোমও মারবে। মাস্লম্যান বলে কতা!’
আবার বোম! শুনে সিঁটিয়ে গেনু। হল কী ব্যাটাদের? কথায় কথায় বোম মারার হুমকি দিচ্ছে! বাঘটাও বোম বানাচ্ছে! আর এ তো দেখছি ‘বম্বম্যান’ সঙ্গে নিয়ে ঘুরছে!
‘বুনিপ ভালো ইংলিস্স্স্ জানে! তাই ওকে এনেছি...!’ সাপটা বলল—‘কি রে বুনিপ্, বল তো!’
বুনিপ লম্ফ মেরে বলল—‘গর্র্র্রর্ গ্রুউউউউম ঘ্রুউউউউম ঘ্যাঁচাং ঘ্যাঁচ...ফ্যাঁচাং ফ্যাঁচ ...ভ্রুম্ভ্রুম্ ঘ্যাঁক...বাম্বু বাম্বু বাম্বু বাম্বু...’।
আমি পুরো হাঁ! বাম্বু শুনে তোম্বু মেরে গেলুম!
‘এটা কী!’
সে জানায়—‘আজ্ঞে ইংলিস্স্স্’।
‘কিন্তু...!’ আমতা আমতা করে বলি—‘কিছুই তো বুঝলাম না!’
‘সে তো জানি’। ব্ল্যাক মাম্বা ন্যাজ দোলায়—‘তাতে কী এস্সে যায়? নেতা-মন্ত্রীরা যে ইংলিস্স্স্ বলেন, তা'ও কি ছাই বোঝা যায়? সেই জন্যিই তো ওঁর এত নাম ডাক!’
‘অ্যাঃ?’
সাপটা চোখ বুঁজে ভাষণ দিতে শুরু করলো—‘স্সুনুন, আমাদের আন্ডার এস্টিমেট করবেন না মোসাই। আমরা ডাইরেক্ট স্সাপ! এই রাজনৈতিক নেতা আর কবিদের মতন ইনডাইরেক্ট স্সাপ নই। সিজিনে খোলস পেলেও কোনও মুখোসস্ পাবেন না। কোনও ফাইল নেই! একদম সিবের গলা থেকে নেমে এইচি। ডাইরেক্ট ছোবল মারি!’
আমার চক্ষু চড়কগাছ—‘কী-ই-ই? আফ্রিকায় সি-ই-ব! ঢপ মারার জায়গা পান্ না!’
সাপটা চিড়িক চিড়িক করে বার দুই জিভ বের করে বলল—‘স্সিব কোথায় নেই? আফ্রিকায় স্সিব নেই? স্সিঙ্গির বাকল পরে থাকা, ভস্সো মাখা, ডম্রু হাতে কত্ত স্স্সিব!—বঙ্গ ছেড়ে কঙ্গো গিয়ে দেখুন। স্সিব ওখানে কঙ্গো বাজাচ্চে! আফ্রিকান ডম্রু। স্সারা উগান্ডা, কেনিয়ায় গিজগিজ করছে সিব। জুলুদের কাছে যান। ওখানে সিব ছালবাকল ফেলে দিয়ে দৌড়োচ্ছে , পেছনে ব্ল্যাক মাম্বা! সামনে কালো কুচকুচে পাব্বতী। যাক্গে, সিব-টিব ছেড়ে দিন্। ভোটটা দিচ্ছেন কিনা বলুন। নন্দী-ভৃঙ্গি এতক্ষণ জিভ বের করে ছিল। ‘স্লা’ দের দুটো করে ছোবল মেরে এইচি! এক্কনও ঝিমুচ্চে। বলেন তো আপনাকেও দুটো ডোজ দিই! বেস্স্ বিনা পয়সায় নেসা হবে!’
আমি লম্ফ মেরে পিছিয়ে যাই—‘ওরে ব্বাপ!’
‘বা-আ-প নয়!’ ব্ল্যাক মাম্বা মাথা নাড়ল—‘স্সা-আ-প! আরে, আমাকে ভোট দিলে কত স্সুবিধে বলুন। কোনও বিচারব্যবস্থার দরকার নেই। কোনও পুলিস-ফুলিস লাগবে না। কোর্ট নেই, উকিল নেই, জজ নেই, তারিখের পর তারিখ নেই! স্ট্রেট বিচার—এক ছোবলেই ছবি! মারবো এখানে, লাসসস্ পড়বে স্সসানে! কোনও মগজমারি নেই। কোনও খচ্চা ছাড়াই স্অ-অ-অ-ব খুনি, রেপিস্টকে গচ্চা করে দেবো। কোনও স্সালা পোতিবাদ কত্তে পারবে না! স্সাপের বিরুদ্ধে কোর্ট-কেস হয় না। তাপ্পর ভেবে দেখুন! বুলাদির লুডু খেলতে নকল সাপ লাগবে না। দিব্যি আমার স্সাঙ্গোপাঙ্গোদের নিয়ে খেলতে পারবেন’!
ভয় পেয়ে বলি-- ‘আচ্ছা, ঠিক আছে, ঠিক আছে, ঠিক আছে...!’
‘গান গাইলে হবে না দিদি,ভোটটা দিচ্চেন তো?’ ব্ল্যাক মাম্বাটা এবার ন্যাজের ওপর ভর দিয়ে পুরো ছ’ফুট লম্বা হয়ে দাঁড়িয়ে পড়েছে—‘ বলচিলেন্ না স্সাপ দাঁড়াতে পারে কি না! এই দেকুন, জাপানি তেল ছাড়াই দাঁড়িয়ে পড়িচি! অনেকক্ষণ ধরে ভদ্দরনোকের মত কতা বল্চি। এবার বলুন, ভোট দেবেন কি না! নয়তো...!’
আমি প্রচন্ড ভয়ে চিৎকার করে উঠি—‘ওরে কে আছিস্? বাঁ-চা-আ-আ!ইন্টারপোলকে ডাক্, দেবকে ডাক,মহাদেবকে ডাক...
হঠাৎ কী হল কে জানে, সাপটা সটান শুয়ে পড়ে ছটফট করতে করতে বলল—‘ওরে বাবা রে, আমার অ্যাপেনডিক্সস্স্ ব্যথা কচ্চে!’
আমি থম্কে যাই। চোখ কুঁচকে বলি—‘ফাজলামির জায়গা পান্না? সাপের অ্যাপেনডিক্স? কদিন আগে একটা বাঘ ঢপ্ মেরে গেল! বলল, ওর ফেভারিট কালার নাকি লাল! বাঘ রঙ দেখতে পায় কখনও? আর আপনি আমায় সাপের অ্যাপেনডিক্স দেখাচ্ছেন? ভোটারদের কী ভেবেছেন মশাই? আমরা গাধা?’
‘অ্যাপেনডিক্সস্স্স্ থাকে না বলচেন?’ সাপটা মিটমিট করে তাকিয়ে থেকে ফের কঁকিয়ে উঠল—‘তবে বোধহয় লেবার পেইন, ওরে বাবা—মরে গেলুম!’
এবার সিরিয়াসলি ক্ষেপে গেলুম। আর ভয়ের কারণ নেই। ব্যাটার অ্যান্টিভেনাম পেয়ে গেছি। রীতিমত গর্জন করে বলি—‘আপনি তো মশাই মেল সাপ! মেল হয়ে লেবার পেইন! গুল মারার যায়গা পান না?
‘দরকার নেই!’ ব্ল্যাক মাম্বা হাঁউমাউ করে বলল—‘আমি আত্মহত্যাই কচ্চি! এই দুনিয়া থেকে চলে যাব, স্স্রে যাব! এই বুনিপ্! কোথায় রে? আমায় এট্টু ধর্!’
বলাই বাহুল্য দুই মূর্তি ঝড়ের বেগে সেই যে গেল, আর ফেরেনি!
বাড়িতে একথা বলার পরই এবার বাবার মুখ গম্ভীর হয়ে গেল! মায়ের মুখ কাঁদোকাঁদো। দাদা বলল—‘দাঁড়া। মনে হচ্ছে গোলমালটা মাথারই। আমি সুবিমলদাকে ফোন করছি। দু একটা সিটিং আর ওষুধেই কাজ হয়ে যাবে’।
কী আশ্চর্য! এরা সত্যিই আমাকে পাগল ভেবে বসে আছে দেখছি! আমি রেগেমেগে বললাম—‘ সিটিং, মিটিং এর কোনও দরকার নেই’!
মা হঠাৎ করে ভেউভেউ করে কেঁদে উঠলেন—‘ওরে, তুই কি ফেভিকল্ বা কোকেন খাচ্ছিস্? সত্যি করে বল্...!’
দেখেছ! এখন সবাই সিটিং ছেড়ে আমার ইটিং নিয়ে পড়েছে। একেই ওদিকে বাঘ আর সাপ মিলে আমায় চমকাচ্ছে। এদিকে বাড়ির লোক রাঁচির টিকিট বুক করার জন্য উঠে পড়ে লেগেছে! সত্যি সত্যিই যে ব্যাটারা এসেছিল কেউ বিশ্বাস করছে না! ধুস্ শালা, আমার ব্যাড লাকই খারাপ!
মা আরও কিছুক্ষণ ফোঁৎফোৎ করে উঠে পড়লেন। দাদা শার্লক হোম্সের মত কিছুক্ষণ ভুরু কুঁচকে সন্দেহজনক দৃষ্টিতে আমাকে মেপে নিয়ে চলে গেল! আমি পাত্তা দিলুম না! বললেই হল যে ভুল দেখেছি? নিজের চোখে দেখলুম...!
চিন্তায় রাতে ঘুম এল না। কী করে এদের বিশ্বাস করাব যে সত্যিই বাঘ আর সাপ এসেছিল! ওরা সবাই আমায় পাগল ভাবছে। কিন্তু আমি জানি, ঘটনাটা অবিশ্বাস্য হলেও সত্যি। কিন্তু কেউ বিশ্বাস করবে না আমায়। বেশি কিছু বললে কপালে নির্ঘাৎ রাঁচিযাত্রা নাচছে!
মনের দুঃখে বিছানায় শুয়ে এপাশ ওপাশ করছি, আচমকা দরজায় খুট্খুট্ করে আওয়াজ! আওয়াজটা খুব জোরে নয়, কেউ যেন খুব সন্তর্পণে কড়া নাড়ছে। কে যেন মিহি গলায় আবৃত্তিও করছে-- ‘দুয়ার এঁটে ঘুমিয়ে আছে পাড়া/ সহসা শুনি রাতের কড়া নাড়া...!’
আমি উঠে দরজা খুলে বললুম—‘অবনী বাড়ি নেই। আপনি আবার কে?’
কিন্তু আশ্চয্যি! সামনে কেউ নেই! বেবাক ভোঁ ভাঁ! আমি চোখ কচলে দেখলুম! নাঃ, সামনে তো কেউ নেই! তবে?
‘আজ্ঞে, আমি এইখানে!’ নীচ থেকে আওয়াজ এল—‘একটু নীচের দিকে কৃপাদৃষ্টিপাত করুন!’
নীচের দিকে তাকিয়ে আমার মাথার চুল পুরো খাড়া! কী সাঙ্ঘাতিক! একখানা দশাসই কুমীর! তার ওপর আবার হাঁ করে আছে! মাথায় সাদা সাদা শনের মত কতগুলো কী যেন! সারা গায়ে চকরাবকরা কতগুলো কী যেন! দাঁতগুলো কী ভয়ঙ্কর! ঐ দাঁতের এক কামড় খেলে আমি তো নির্ঘাৎ গেছি!
আমার মনের ভাব বুঝেই বোধহয় সে হাঁ মুখ বন্ধ করল—‘ইয়ে, মানে ভয় পাবেন না। আমার নাম কুকুমীর! আমি আপনাদের কৃপাপ্রার্থী’।
এইটুকু বলতেই ব্যাটা কয়েক মিনিট কাটিয়ে দিল। কারণ, একটা শব্দ বলেই সে হাঁ করে থাকে। চোখ পিট্পিট্ করে। আবার মুখ বন্ধ করে একটা শব্দ বলে! আবার হাঁ করে। আবার একটা শব্দ! অধৈর্য হয়ে বলি—‘আপনি কি চিরকালই এমন পজ্ দিয়ে কথা বলেন? না আজ বিশেষ কোনও অকেশন আছে?’
‘না...না!’ সে বললে—‘আসলে আমার একটু ডেন্টাল প্রবলেম আছে। রুট ক্যানাল করানো হচ্ছে কিনা!’
মনমরা হয়ে বলি—‘তবু ভালো আপনার ডেন্টাল প্রবলেম। কিন্তু এই কথা যদি বাড়িতে বলি, তবে লোকে ভাববে আমার মেন্টাল প্রবলেম। বাই দ্য ওয়ে,মাথায় ওটা সাদা সাদা কী!’
‘আজ্ঞে উইগ!’ কুমীরটা দন্ত বিকশিত করেছে—‘সবাই বললে রাজনীতি করতে এলে পাকা মাথার দরকার! তাই একখানা পাকা চুলের উইগ কিনেছি। আর গায়ের ওগুলো দেখে ভয় পাবেন না। ধুতি পাঞ্জাবী পরলেই সব ফুটো হয়ে যাচ্ছে। তাই গায়ের চামড়া নরম করার জন্য কাঁটিয়াল করাচ্ছি!’
‘কাঁটিয়াল!’ আমার মুখটা প্রায় কুমীরের মতই হাঁ হয়ে গেল—‘সেটা কী?’
‘আজ্ঞে, আপনাদের চামড়ায় ফেশিয়াল হয়!’ কুমীরটা দুঃখু দুঃখু মুখ করে চিমটি কেটে চোখ থেকে গোটা কয়েক অশ্রুবিন্দু বের করে বলল—‘আমার তো সারা গায়েই ‘কাঁটা লাগা’ কেস! তাই কাঁটিয়াল করছি!’
আমার রীতিমত অধৈর্য লাগছিল। ব্যাটা এত ফুটেজ খায় কেন? একটা শব্দ বলে! মাঝখানে হাঁ করে অন্তহীন পজ্! বিরক্ত হয়ে বলি—‘দেখুন, বেশি সময় নেই। কী বলবেন তাড়াতাড়ি বলুন’।
‘এই যে, বলি!’ ঢুলুঢুলু চোখ করে কুমীরটা বলল—‘আমি দাদার দলকে এবার রিপ্রেজেন্ট করছি। আমায় যদি ভোটটা দেন বড় ভালো হয়!’
‘কেন দেব?’
‘কেন?’ সে জানায়—‘দেখুন, আমার চেয়ে যোগ্যতর প্রার্থী আর নেই। এখন স্বচ্ছ ভারত অভিযান চলছে। এমনিতেই আমি যে রাস্তা দিয়ে যাই, লেজের ঝাপটে সব সাফা হয়ে যায়। দরকার পড়লে লেজের সঙ্গে গোটা কয়েক ঝাঁটাও লাগিয়ে দিতে পারেন! পুরো রাস্তা ঝকঝকে হয়ে যাবে। আয়নার দরকার পড়বে না। দিব্যি রাস্তাতেই মুখ দেখে নিতে পারবেন! তারপর গোটা দিন হাঁ করে বসে থাকব। সমস্ত পোকা মাকড় মুখে ঢুকে গেলে মুখ বন্ধ করে দেব। কথা দিচ্ছি এমন করেই স্বচ্ছ ভারত তৈরি করবো।’
‘আর কী কী দুর্নীতি করবেন?
কুমীরটা জিভ কাটল—‘ছি ছি! কী যে বলেন! দুর্নীতি করতে গেলেও তো কিছু না কিছু কাজ করতে হবে। কাজই করবো না তো দুর্নীতি আসবে কোথা থেকে? এতবড় শরীর নিয়ে নড়াচড়া করতেই প্রায় চৌত্রিশ বছর লেগে যায়! দুর্নীতি তো বহুদূর! তবে আমার একটা চাহিদা আছে’।
‘কী চাহিদা?’
‘এই কয়েকটা মাত্র পুলিশে কাজ হবে না। আমার জন্য জলপুলিশ ও স্থলপুলিশ, দুই-ই মোতায়েন করতে হবে। ব্ল্যাক ক্যাটদের সাঁতার শিখতে হবে। আর বাড়িতে একটা প্রমাণ সাইজের সুইমিংপুল করে দিতে হবে। আমি যা যা কবিতা লিখব—সব ছাপাতে হবে। আমি বুদ্ধিজীবী তাই গদি চাই-ই চাই। আর কিছু চাইনে!’
আমি কিছুক্ষণ তার দিকে তাকিয়ে থেকে বলি—‘সে তো বাঘও বলেছে তার দশ কেজি মাংস ছাড়া কিছু চাইনে! সুইমিংপুলের চেয়ে দশ কেজি মাংস অনেক সস্তা!’
এবার কুমীর একটু রেগে গিয়ে বলে—‘ঐ অলপ্পেয়ে বাঘটা আপনার কাছে এসেছিল বুঝি? একদম পাত্তা দেবেন না! ওর কোনও ক্লাস আছে? এক নম্বরের ঘটি। খেয়ে দেয়ে মুখ সাফ করে বলবে—‘খেলুম’! কী যে খেলো, কতটা খেলো, পেট ভরলো কি-না কিছুই বুঝবেন না। আর আমাকে দেখুন। খেয়ে এত্তবড় হাঁ করে বলব—‘খা-আ-ই-লা-আ-ম!’
‘অ!’ ব্যাটাকে একটু খোঁচাতে ইচ্ছে করল—‘ও ঘটি। ওর ক্লাস নেই। আপনার আছে?’
‘নিশ্চয়ই’। কুমীরটা গম্ভীর মুখ করে বলতে শুরু করেছে—‘আমার পূর্বপুরুষ ডাইনোসর ছিল! জুরাসিক পার্ক দেখেছেন? সেখানে লেখা ছিল ‘ডাইনোসোরস্ রুলড্ দ্য আর্থ। ডাইনোসোর রাজা ছিল। আর সেই রাজার রক্ত বইছে আমার শরীরে। সাহিত্যেও আমার অবদান কিছু কম নেই। আমি না থাকলে ত্রৈলোক্যনাথ ‘কুম্ভীর বিভ্রাট’ কী করে লিখতেন? আমার ছোট ভাইকে নিয়ে মানিকবাবু লিখেছিলেন ‘সরীসৃপ’! আমি কি যেমন তেমন প্রার্থী? আমি রাজার বংশের লোক। কাব্য ও সাহিত্যের অভিভাবক ও অধ্যাপক। নীল রক্তের লোক। তাই নীল রঙেই ভোট দেবেন।’
ওর ভাষণ শুনে ঘুম পেয়ে গিয়েছিল। এবার ওর মতই পেল্লায় হাঁ করে হাই তুলে বললুম—‘বুঝেছি। অনেক ফুটেজ খেয়েছেন। এবার ফুটুন তো!’
‘ছিঃ!’ পিটপিটে চোখ দুটোকে যথাসম্ভব গোলগোল করে বলল কুমীরটা—‘অপশব্দ বলতে নেই ভাই’।
অপশব্দের নিকুচি করেছে। ব্যাটার মুখের ওপরই দরজাটা বন্ধ করে দিলুম। একেই বাঘ আর সাপের ভাষণ শুনে মাথা গরম হয়ে রয়েছে! তার ওপর কুমীরটা আবার রাতের ঘুম মাটি করতে লেগেছে। বিরক্ত হয়ে বালাপোশের ভিতরে সেঁধিয়ে গেলুম! মনে মনে ঠিক করি, এ কথা মরে গেলেও কাউকে বলব না! একেই বাঘ, সাপে রক্ষা নেই! তার ওপর কুমীর! একথা বললে নির্ঘাৎ দাদা পাকড়াও করে পাগলের ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাবে। তারপর সেই ডাক্তার হয় ফুটোস্কোপ দিয়ে আমার মুন্ডুটা দেখবে, নয় ইলেক্ট্রিক শক দেবে। অত ঝকমারিতে আমি নেই। অতএব যা হয়েছে চেপে যাও!
যেমন ভাবা তেমনি কাজ। পুরো ঘটনাটা হজম করে ফেললুম। দাদা দু-একবার ফেলুদা মার্কা দৃষ্টিটা এরমধ্যেই ফেলে গেছে। পাত্তা দিইনি। ঠিক করেছি, ডোরবেল বাজুক কিম্বা কড়া নাড়ার শব্দ হোক্, হারগিস দরজা খুলবো না! এমনকি জানলাও খুলবো না। কুমীর অবধি চলে এসেছে। এরপর কে আসবে কে জানে! খুলবো না! যেই আসুক, কিছুতেই দরজা খুলবো না!
কিন্তু তাতেও রক্ষা নেই! পরদিন ভরদুপুরে ফের বন্ধ দরজায় ঠক্ঠক্! ও প্রান্ত থেকে বিনীত কন্ঠস্বর ভেসে আসে—‘কেউ আছেন?’
‘কেউ নেই’। কড়া সুরে জবাব দিই—‘কে আপনি? শেয়াল? যা লেখার, যা বলার দেয়ালে লিখে যান। আমার সময় নেই’।
‘আজ্ঞে আমি শেয়াল নই’।
‘তবে? ভালুক? তাহলে সামনের পুকুরে গিয়ে শাপলা শালুক ভক্ষণ করুন। আমার বাড়িটা আপনার খাস তালুক নয়!’
বিনীত স্বর হেসে বলল—‘আমি ভালুকও নই’।
‘তাহলে নির্ঘাৎ হায়না! শুনুন মশাই , কোনও বায়না চলবে না। কেটে পড়ুন’।
‘আমি হায়নাও নই। একজন মানুষ মাত্র’।
মানুষ! তবে আর ভয়ের কী আছে? এইবার লাফ মেরে উঠে দরজা খুলে দিই। বাইরে এক অনিন্দ্যসুন্দর মানুষ দাঁড়িয়ে। কিন্তু রূপ দেখে গলবার পাত্রী নই আমি। বিল ক্লিন্টনও হেব্বি হ্যান্ডসাম ছিল। কিন্তু ভিতরে ভিতরে পাজির পাঝাড়া।
‘কী চাই?’ বেশ রোয়াব নিয়েই জিজ্ঞাসা করি। মানুষটা স্মিত হাসল। হাসিটা এত শুদ্ধ যে প্রাণ ঠান্ডা হয়ে যায়। লোকটা কোনও রকম ভনিতায় না গিয়ে বলল—‘ভোটপ্রার্থী। যদি আমাকে যোগ্য প্রার্থী বলে মনে করেন তবেই ভোট দেবেন’।
এ কী! এ তো ভোটপ্রার্থীদের জেনারেল ডায়লগ নয়! বিস্মিত হয়ে বলি—‘কোন্ দল? দাদা? না মাসিপিসি?’
সে ফের শান্ত হাসল—‘আমি দলে বিশ্বাসী নই। পিসো , পিসি, দাদা—কাকু ধরি না’।
বিস্ময়ের পারদ চড়ল। বলে কী লোকটা!
‘তবে কিসে বিশ্বাস করেন? রঙে?’
‘নাঃ। আমার কোনও রঙ নেই। আমি রঙে বিশ্বাস করি না’।
‘তবে কিসে বিশ্বাস করেন? ভগবানকে?’
‘নাঃ’। তার শান্ত উত্তর—‘নিজেকে। আর নিজের কাজকে’।
‘আপনি তো মানুষ! বলি মান, হুঁশ আছে’?
‘দুটোই আছে’।
‘মিথ্যে কথা!’ প্রতিবাদ করি—‘মান হুঁশ থাকলে কেউ ভোটে দাঁড়ায়?’
‘আমার দুটোই আছে’। লোকটা একটুও না রেগে শান্ত স্বরে বলল—‘আমি অপ্রয়োজনে মিথ্যে কথা বলি না। বলিনি কখনও’।
বিস্ময়ের থার্মোমিটারে পারদ ক্রমাগতই চড়ছে!
‘আপনি ঘুষ খান?’
‘নাঃ’।
‘বোম বাঁধতে জানেন? বেঁধেছেন কখনও?’
‘নাঃ’।
‘মানুষ খুন করেছেন?’
‘আজ্ঞে না। তবে মানুষকে বাঁচিয়েছি অনেকবার’।
‘রেপ করেছেন?’
‘না’।
‘আপনার চাহিদা কী? ভোটে জিতলে কী চাইবেন? লিমুজিন? সাফারি? রোল্স রয়েস?’
‘আমার ওসব প্রয়োজন নেই। আমার প্রয়োজন খুব সামান্য’। লোকটা হাসল—‘সেটা নিজেই মিটিয়ে নিতে পারি। আমি শুধু কাজ করতে চাই!’
টের পেলাম বিস্ময়ের থার্মোমিটারটা ফটাস্ করে ফেটে গেছে! আমার মাথা ঘুরছে! কানের ভেতরটা বোঁ বোঁ করছে। দাদা তবে ঠিকই বলেছিল...!
আমি লাফ মেরে সরে গিয়ে অন্ধের মত হাত পা ছুঁড়লাম—‘এই যাঃ! হুশ্ হুশ্! সব ঝুঠ হ্যায়...সব ঝুঠ হ্যায়...! তফাৎ যাও...তফাৎ যাও!’
লোকটা অবাক। কিছু বোধহয় বলতে চাইছে। কিন্তু আমি শুনতে পাচ্ছি না!...অসম্ভব!...অসম্ভব!
প্রাণপণে চেঁচিয়ে কেঁদে উঠলাম—‘ওরে বাবা রে, মা—রে , দাদা রে, এ আমার কী হল রে! বাঁ-চা-ও!’
আমার হাঁকডাক শুনে সকলেই ছুটে এল। দাদা তাড়াতাড়ি বলল—‘কী হয়েছে? কী হয়েছে রে? চেঁচাচ্ছিস কেন?’
‘ওরে!’ আমি আকুল ভাবে কাঁদতে কাঁদতে বলি—‘দাদা রে-এ-এ! তুই ঠিকই বলেছিলি! আমার হ্যালুসিনেশনই হচ্ছে! নয়তো একটা মানুষ এসে বলে কিনা ভোটে দাঁড়িয়েছে!’
‘তাতে কী?’ বাবা অবাক—‘বাঘ, সাপ যদি দাঁড়ায়, তবে মানুষ কী দোষ করেছে?’
আমি আরও জোরে মড়াকান্না কেঁদে উঠি—‘বাঘ, সাপ, কুমীর সবাই ভোটে দাঁড়াতে পারে! কিন্তু যার মান আর হুঁশ আছে সে কীকরে ভোটে দাঁড়ায়! তার ওপর বলে কিনা কোনও দল করে না, রঙে বিশ্বাস করে না, ভগবানে বিশ্বাস করে না, শুধু নিজেকে আর নিজের কাজকে বিশ্বাস করে! অ্যাঁ! এমন হয় নাকি! মিথ্যে কথা বলে না! ঘুষ খায় না! বোমা বাঁধে না! মানুষ খুন করেনি, বরং বাঁচিয়েছে! রেপ করেনি! আর কোনও দাবি নেই, শুধু নিজের কাজ করতে চায়! এমন মানুষ ভোটে দাঁড়াতেই পারে না! অসম্ভব! অসম্ভব! হ্যালুসিনেশন! নির্ঘাৎ হ্যালুসিনেশন! ওরে দাদা রে, তুই সুবিমল, নির্মল, পরিমল, কমল—সব মলকে ডাক, সাইকায়াট্রিস্ট ডাক, সাইকোলজিস্ট ডাক! দরকার পড়লে রাঁচি থেকে গোটা অ্যাসাইলামটাই নিয়ে আয়! আমি ইলেক্ট্রিক শক্ খেতেও রাজি আছি! অসম্ভব! অসম্ভব! ওরে বাবা রে, এমন মানুষ কিছুতেই রাজনীতিতে আসতে পারে না। ভোটে দাঁড়াতে পারে না! হ্যালুসিনেশন! নির্ঘাৎ হ্যালুসিনেশন! আমার মাথা নির্ঘাৎ খারাপ হয়েছে রে—এ-এ-এ! ওরে বাবা! মানুষের মত মানুষ কি না ভোটে দাঁড়িয়েছে! অসম্ভব! হু-উ-শ! হু-উ-শ! তফাৎ যাও...সব ঝুঠ হ্যায়!
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন
Thanks for your valuable comment.