ভিন্নগদ্য


আমার পাড়ায় বর্ষা 
অন্তরা দাঁ

মেঘ মেখে ঘুমিয়ে পড়েছি খুব, ঘুমের ভেতর দিব্যি হাত-পা ছড়িয়ে, ছুটে খেলে বেড়াচ্ছি ছোটবেলা'র মাঠে, আদিগন্ত সবুজের জাজিমে, ভোরের আলো-মাখা নীলচে মায়া'য়, মেঘ ঝুঁকে আসা সকালে যখন ছদ্ম সন্ধে'র ছায়া ঘনিয়ে আসে, সেই রূপকথা'র রাজ্যে। আমাদের শৈশবে একটা মস্ত মাঠ ছিল, খেলার মাঠ, বুকে'র খুব গোপনে, সে মাঠে আজও যাই, সময়ে-অসময়ে। তেপান্তরে'র সেই মায়া-রাজ্যে কবে'ই হারিয়েছি ছেলেবেলার রঙিন ঘুড়ি, ভো-কাট্টা হয়ে উড়ে গেছে সে আমায় ছেড়ে! তবু এখনো ঘুমঘোরে সে আসে, আলতো করে হাত রাখে আমার চোখে, মায়া-কাজল পরিয়ে নিয়ে যায় কোথায় কোথায়, সেই কবেকার ভুলে যাওয়া প্রাইমারী ইস্কুলে'র খেলনা-বাটি'র দিন, সারদিন ঝিমঝিম বৃষ্টি, বাড়ি থেকে বেরোনো'র জো নেই, জানলায় পাখি'র ছানা'র মত শরীরটুকু আটকে মন'টা পাড়ি দিয়েছে সঙ্গী-সাথীদের খোঁজে, সারা বাড়ি ম' ম' করছে ইলিশে'র গন্ধে, শুকনো লঙ্কা আর কালোজিরে ফোড়নে'র ঝাঁঝে মিশিয়ে নিয়েছি দুঃখু দুঃখু সময়, মা ডাকছে শুনতে পাচ্ছি, 

—জামাকাপড় গুলো তোল রে, আবার জল এলোওওওওও...

পাশে'র ডোবায় একটা হলুদ ঢোঁড়া চিৎ সাঁতার দিচ্ছে কেমন, কচুপাতা মাথায় দিয়ে যাই না একবার রুনুদে'র বাড়ি! কতবার তো উঠোনে নামছি, ছাদে যাচ্ছি! কী সবুজ কী সবুজ চারদিক! যেন গাছগুলো সব সবুজ ওড়না দিয়েছে বুকে! আর বৃষ্টি এসে সেই ওড়না'র ওপর চুমকি বসিয়ে দিচ্ছে! পদ্মপাতা'র ফাঁকে ফাঁকে লাফিয়ে উঠছে খলসে মাছ! আমাদের ভুলু কুকুর'টা গা ঝাড়া দিচ্ছে আবার বেরিয়ে যাচ্ছে বাড়ি থেকে, মাঝে মাঝে কোথায় যেন! আমার'ই বেরোনো'র হুকুম নেই! ছোট্ট ভাই আছে একটা,সে শুধু দুধ খায় আর ঘুমোয়, তার ক্ষুদে ক্ষুদে আঙুল ধরলেই মা এসে আমায় বকে, 

—উঠে যাবে না, ঘুম থেকে!? 

এমনিতেই নাকি বর্ষাকালে বাচ্চা'রা বেশি বেশি শু শু করে, কাঁথা হয় অনেক। বাবা একখানা কাঠের বাঁটে'র মস্ত কালো ছাতা মাথায় দিয়ে জমি দেখতে বেরোতো, আমি দো-তলা'র জানলা থেকে অনেকদূর অবধি দেখতে পেতাম সেই ছাতা'টা, তারপর ঝাপসা হয়ে আসতো, জীবনেও এমনই হলো, স্পষ্ট সবকিছু দূর থেকে বহুদূরে চলে গেলো, বাবা'র সেই ছাতা'টার মতো, অনেকদিন পর সেটাকে আবিষ্কার করেছিলাম, চিলেকোঠার ঘরে, আবর্জনা'র স্তূপে। ততদিনে রঙিন বাহারি স্টিলের ছাতা'য় বাজার ছেয়ে গেছে! জানলা'র গরাদে'র ফাঁক দিয়ে হাত বাড়িয়ে বৃষ্টি ছুঁতাম, মুখে চোখে মাখতাম! ছাদে কাপড় তুলতে গিয়ে চোখ যেত দূরে আরও দূরে, মাঠঘাট সাদা হয়ে আছে, রাস্তার দুধারে নালায় উপচে পড়ছে ঘোলা জল, ছোট ছোট ঘূর্ণি তাতে, কতবার সেখানে ভাসিয়েছি কাগজের নৌকা, তারা একটুখানি ভেসে,গোত্তা খেয়ে কাত হয়ে ডুবে গেছে, যাহ! আমি আবার ভাসিয়েছি, ভেসে যাবে না জেনেই। ছাদে'র আলসেতে শ্যাওলার পুরু আস্তর, বটে'র চারা দু'একটা, মা হাত বাড়িয়ে পটাপট ছিঁড়ে দেয়, আমি পারিনা, আমার মনে হয় ওই চারাগাছ'টি যদি বড় হয়, ঝুরি নামে, লাল লাল বটফল হয়! ছোটকাকা মাথায় চাঁটি দিয়ে বলে 

—তোর মাথা'য় গোবর ভরা আছে, আলসেতে বটগাছ হয়?    

হয়না বুঝি?! সবকিছুই কী নিয়ম মেনে হয়? এ জীবন?এক জীবনে? স্বপ্নের বটচারা'য় যে আমার ঝুরি নেমেছে, সেই ঝুরি'তে দোল খেয়েছি সুখে'র রাতে, এসব খবর কেউ কী জানে!  স্বপ্নে যত বৃষ্টি'র দিন, তল-আঁধারি বটে'র ঝুরি,প্রেমে'র ভাঁজে নৌকা-ভাসান, ছাদের সিঁড়ি'র জল সপসপ, বাবা'র ছাতা, মায়ে'র বকা, জানলা'র সেই তাকিয়ে থাকা, সব সবকিছু আমার খণ্ড খণ্ড মূহুর্তের মালা গেঁথে পরিয়ে দিয়েছে আমার গলায়,শুকিয়ে গেলেও সে মালা ছিঁড়তে পারা যায়না। শুধু তার গন্ধে'র আতর স্মৃতি'র বাসরঘরে থমকে থাকে আজন্মকাল, কখনও কোন নির্জন সন্ধেয় আমি আজও সে গন্ধ পাই ঠাকুরঘরে পোড়া ধূপ আর গুলগুলে'র সাথে মিশে! কিম্বা হঠাৎ কোন খেয়ালী রাতে'র তানপুরায় মাথা দিয়ে, কোনো একলা ঝড়ের অনুষঙ্গে! চুপচাপ দুপুর হতেই, আমি দে দৌড়, সদর দরজায় খিল পড়ে গেছে, মা-ঠাকুমা'রা দুপুর-ঘুমে মশগুল, আমি তখন পা-টিপে টিপে, খিড়কি'র দরজা দিয়ে পুকুরপাড়ে, পাকুড়তলা'র নাটমন্দিরে'র মেঝেয় আমাদের পুতুল-খেলা, মাটি'র পুতুল, মা'র শাড়ি'র পাড়ে তাদের কাপড়চোপড়, পুরনো বাতিল হয়ে যাওয়া এ্যালুমিনিয়ামের বাক্স'য় তাদের ঘর-দোর! বিকেলবেলা মা হিড়হিড় করে টেনে আনতো বাড়িতে, কান ধরে,  

—বাঁদর, বেয়াড়া, চল বাড়িতে, মজা দেখাচ্ছি! 

পিছনে ফেলে রেখে এসেছি আমার পুতুলখেলা'র সংসার, রান্নাবাটি'র দিন আর একটা বর্ষার দুপুরে আমার গিন্নী হয়ে ওঠার স্বপ্ন! 

সন্ধেবেলা ভুতুমপেঁচা'র দুরগুম দুরগুম গা-ছমছম আওয়াজ,ব্যাঙ ডাকতো, হ্যাজাকের আলোর বৃত্তে গোল করে উড়তো বাদলপোকা, রান্নাঘরে দৌড়ে যেত ধেড়ে ইঁদুর, সরসর করে সাপ যেত উঠোনের কামিনী গাছটা'র তলা দিয়ে, কইমাছ উঠে আসতো রাস্তা'য়, শাঁখে'র আওয়াজ ছাপিয়ে তেড়ে বৃষ্টি আসতো আবার! আমার পড়া'য় মন নেই তখন, গোল হয়ে পড়তে বসতাম তুতো ভাইবোনে'রা, সাদা-কালো টিভি'তে সিনেমা'র গান হতো, 

—রিমঝিম গিরে সাওন, সুলগ সুলগ... 

পাশে'র বাড়ি থেকে আওয়াজ আসতো, টিনের চালে ঝমঝম শব্দ, মা হয়তো তখন সম্বর দিয়েছে খিচুড়ি'তে। সেই রূপকথার দিন-রাত্তি'র গুলো ম্যাজিকে'র মতো কে যে হাওয়া করে দিলো এক নিমেষে! 

এখন রঙিন বর্ষাতি আছে, সবুজ কচুপাতা নেই, একলা কফিকাপ আছে, গরম চা-মুড়ি নেই, খিচুড়ি রিপ্লেস করেছে মশালা ওটসে'র রেডি টু ইটে'র পাউচ, বাদল দিনে'র দুপুর-পালানো ইচ্ছে নেই, কিছু নেই, কিচ্ছু নেই আর! 

—আরে, ওঠো ওঠো! 

ধড়মড় করে উঠে বসি, বৃষ্টি নেমেছে খুব, বর্ষা, আহা! কী যে ভালোলাগে! ফিসফিসিয়ে বলি... 

—দরজায় আজ কড়া নেড়েছে সে! 

গুনগুন করি "এমন দিনে তারে বলা যায়.. "

—হ্যাঁ, কড়া নেড়েছে, তবে বর্ষা নয়, জোম্যাটো, রান্না'র লোক ফোন করেছিল, আসবে না আজ, রাতে খেতে হবে তো! 

সন্ধে ছাপিয়ে রাত এলো তবে...ঝড়ের রাত...তোমার অভিসার...! ! ! 

মন্তব্যসমূহ

জনপ্রিয় পোস্টসমূহ